দুর্বল হাতে শরীরে বসা মাছিগুলোকে সরানোর চেষ্টা করতে করতে শীতে কাঁকিয়ে ওঠা নরোত্তম আপন মনেই গালি দেয় "শালার শীত!"
ইদানীং শীত নরোত্তমের জন্য অনেক বড় এক সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। সোয়েটার, জামাকাপড় পড়লে শরীরের ফোস্কাগুলো গলে যায়; গ্যাদগ্যাদ ত্যাকত্যাকে হয়ে যায়। এমনিতেই ওগুলো থেকে বিশ্রী গন্ধ বের হয়; সোয়েটার গা দিলে তো মাংসপঁচা গন্ধের কারণে থাকাই যায় না। তারওপর আবার ঘাগুলোতে কাপড় সোয়েটার লেপ্টে থাকলে তুলনামূলক বেশি চুলকায়। এমনিতেই দ্যাগদ্যাগে ঘা, তার ওপর নখের আঁচড় হাজার রকম সমস্যা।
আবার সোয়েটার না পড়লেও বিপদ। শীতে হুহু করে কাঁপতে হয়। মনে হয় শরীরে কে যেন বরফের ছুরি বসিয়ে দিয়েছে।শীত আসলে এই এক সমস্যা।
ইস! মাছিগুলো অসহ্য হয়ে ওঠেছে। " শালার মাছি। তোদের সবকটিরে ঝাঁটা দিয়া পিটায়া মারা উচিত।" নরোত্তম বিড়বিড় করে।
"শিপ্রা, ও শিপ্রা, শিপ্রা আমার শরীরে প্রচন্ড মাছি বসতাছে। মশারিটা টাঙায়া দিয়া যাও।" নরোত্তম শিপ্রাকে বারবার ডাকে। ব্যাপার কি, শিপ্রা গেল কই। বারবার ডাকার পরও কি কথা শিপ্রার কানে যায় না! নাকি জেনেশুনেই অগ্রাহ্য করা।..........হ্যাঁ, জেনেশুনেই তো মনে হয়। হ্যাঁ, এরকমই তো হবে।এতদিন খাওয়াইছে, পিন্দাইছে আর আজ............... নরোত্তমের কান্না আসে। এরকমই তো হবে। মানুষ বিছানায় পড়ে গেলে আর কেউ দেখতে পারে না।সামান্য একটা সাহায্য, সহানুভূতিও আশা করা যায় না। আর........ আরও কি কি মনে আসে। নরোত্তম নিজেও ঠাহর করতে পারে না মাথার ভিতর কি আসছে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর কি জানি নেয়ার জন্য শিপ্রা ঘরের ভিতর ঢুকে। নরোত্তম মুখ ঝামটা মেরে ওঠে " জানি তো। এখন আমারে দেখতে পারতাছ না। মৃত্যু চাও তাই না, মৃত্যু চাও আমার। মরমু না, এত সহজে মরমু না। কখন থেকে বলতাছি একটু মশারি টাঙায়া দাও। দিলে কি হাত পঁইচা যায়?......."
শিপ্রা বিরক্ত হয়ে ওঠে। না জেনে কাউকে দোষ দেওয়া কি ঠিক? সে গেছিল বাজারে। সংসারের সব কাজ তো তাকে একলাই সামলাইতে হয় নাকি! নরোত্তম ইচ্ছা করলেই তো তার উপর যে কোন দোষ চাপায়া দিতে পারে না। সংসারে দশদিকে দশ কাজ; কোনটা রেখে সে কোনটা সামলাবে? অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছা করে শিপ্রার ; কিন্তু সে কিছুই বলে না। নীরবে মশারি টাঙিয়ে চলে আসে।
কিন্তু শিপ্রারও তো একটা জীবন। এ কথাটা কি নরোত্তম একবার ভাবে? মানুষটা পাঁচ বছর ধরে বিছানায় পড়ে আছে।শিপ্রা কি তাকে ছেড়ে চলে গেছে? আর সে যদি নরোত্তমের মৃত্যুও চায়; তাহলে সে তো চাইতেই পারে। আর কত? আর কত সহ্য করবে? তা অবশ্য শিপ্রা চায় না; কিংবা হয়তোবা চায়ও...........ধুচ্ছাই, এ বিষয় নিয়ে শিপ্রা চিন্তা করতে চায় না। তবে একটা জিনিস চিন্তা করার দরকার; নরোত্তম শিপ্রার কি কাজে আসে? সে কি সন্তানদের পড়াশুনার খরচ জোগায়; একটা টাকাও কি ঢালতে পারে সন্তানদের পিছনে; নাকি পারে শিপ্রার শারীরিক চাহিদা পূরণ করতে। তারও কি ইচ্ছা করে না। করে কিনা বল? নানান জায়গা থেকে কুপ্রস্তাব আসে। কই শিপ্রা তো সেগুলো আমল দেয় না। অন্য কেউ হলে ঠিকই এতদিন.........
আসলে শিপ্রা নিজেও এভাবে অসহ্য হয়ে উঠতে চায় না। কিন্তু আর কতদিন। একটা বিহিত তো হওয়াই দরকার।
ভিতর থেকে নরোত্তম ডাক দেয় " শিপ্রা, এই শিপ্রা।"
"কি?"
"আমার প্রচন্ড শীত লাগছে।"
"সোয়েটার গায়ে দাও।"
"কিন্তু সোয়েটার গায়ে দিলে যে ঘা আরও বাড়ে।"
"তো আমি কি করব? আমার কাছে বারবার ঘ্যানঘ্যান করছ কেন?" শিপ্রা বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয়। নরোত্তম নিশ্চুপ হয়ে যায়। নরোত্তম অভিমান করেছে শিপ্রা তা বুঝতে পারে। কাছে গিয়ে বলে, "তুমি শুয়ে থাক, আমি তোমার গায়ে কম্বল দিয়ে দেই।"
শিপ্রা নরোত্তমের গায়ে কম্বল দিতে যায়। নরোত্তম দুর্বল শরীরেই সেটাকে ছুড়ে ফেলার চেষ্টা করে। " না। না। থাক থাক, লাগবে না। দরকার নেই। যাও তুমি তোমার কাজ করোগে, খালি তো কানের কাছে ঘ্যানঘ্যানই করি আমি।" নরোত্তোমের গলার কাছটায় কান্না দলা পাকিয়ে ওঠে।
" এত রাগ কেন তোমার। না দেও গায়ে কম্বল। আমার কি!" শিপ্রা বিরক্ত হয়ে চলে যায়।
নরোত্তমের কান্না আসে, অনেক কান্না। আজ তার কি অবস্থা! অথচ কয়েক বছর আগে সংসারের সেই ছিল অধিকর্তা। কিসুখেই না ছিল। আর আজ!
প্রথম যখন গলায় ব্যাথা দেখা গেল; সে তো ভেবেছিল সামান্য ঠান্ডার সমস্যা, গুরুত্ব দেয় নি মোটেই। শিপ্রা সামান্য কিছুতেই দুশ্চিন্তায় পড়ত; সেই ঠেলেঠুলে পাঠালো ওকে ডাক্তারের কাছে। তারপর এ ডাক্তার থেকে ও ডাক্তার, গলার ঘা থেকে আস্তে আস্তে মুখে ঘা, তা থেকে মাথায়, আস্তে আস্তে সারা শরীর। গলার ডাক্তার থেকে মেডিসিনের ডাক্তার, মেডিসিন থেকে চর্মরোগের। কি থেকে কি। শিপ্রা কি যত্নটাই না করত তার। কান্নাকাটি, রাতদিন পূঁজাঅর্চনা, উপবাস, বলি। সারাদিন আত্নীয় স্বজন দেখতে আসত।
এখন আত্মীয়স্বজনও আসে না, স্কুল পড়ুয়া ছেলেটাও একবছর কোন খোঁজখবর নেয় না। পাশের রোমেই থাকে, অথচ মনে হয় বাবা নামে কখনো কাউকে সে চিনতোই না। নরোত্তমেরও কিই বা দরকার পড়েছে ছেলেকে ডাকাডাকি করতে।কাছে আসে না তো আসেই না। আগে ডাকাডাকি করত। কিন্তু যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছে ছেলেটা বাবাকে পছন্দ করছে না, বরং পঁচা ঘায়ের গন্ধে নাক সিটকাচ্ছে; সেদিন থেকে আর ডাকে না।
বছর তিনেক ধরে শিপ্রাও তার সাথে রাতে ঘুমায় না। ঘা থেকে রস চুইয়ে চুইয়ে বিছানা ভিজিয়ে ফেলে। নরোত্তম কি বুঝে না শিপ্রা তাকে ঘৃণা করে। কিন্তু অসুস্থ হলে কি হবে, তার শরীরেও কি মাঝে মাঝে কামনার আগুন জ্বলে না?
ইদানীং সম্পর্কগুলো শীতল থেকে শীতলতর হয়ে উঠছে।শিপ্রার চোখে আর কোন মায়াদয়া নেই, শুধুই নিস্পৃহতা। অপেক্ষা। শুধুই নরোত্তমের মৃত্যুর অপেক্ষা। তার ছেলে, শিপ্রা, আত্মীয়স্বজন সবসর চোখেই নরোত্তম নিজের মৃত্যুর আকাঙ্খা দেখতে পায়। কিন্তু অত সহজে মরবে না সে বলে দিলাম। এটা তার নিজের জীবন। ভুগুক সবাই। সব কুত্তার বাচ্চা। সবার জন্য সারা জীবন রক্ত পানি করে পরিশ্রম করেছে সে। আর সবাই কিনা এখন............
মশারির বাইরে মাছি ভনভন করছে। সুযোগ খুঁজছে শরীরে বসার, কিন্তু পারছে না। পড়ন্ত বিকাল সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে যেতেই শীত আরও বাড়ে। নরোত্তম শীতে কাঁকিয়ে উঠতে উঠতেই গালি দেয় "শালার শীত!"
২৬ নভেম্বর - ২০১৫
গল্প/কবিতা:
২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪